হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব কোনটি সম্পূর্ণ তথ্য জানুন
হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব কোনটি মূলত তার বিস্তারিত আলোচনা নিয়ে থাকছে আজকের আমাদের এই পোষ্ট এর বিষয়বস্তু। এই আলোচনার সাথে আরও সংযুক্ত হয়েছে বারো মাসে তেরো পূজা মানে ও এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা। তাই আজকের এই পোষ্টের সাথে থাকুন এবং পোস্টটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন যেন পূজা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারেন।
পূজা অনেকেই করে থাকেন কিন্তু পূজার আসল তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য কতজনেই বা জানেন? পূজা সম্পর্কে কমবেশি সবাই অবগত হলেও অনেকেই হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব কোনটি এবং বারো মাসে তেরো পূজা মানে সম্পর্কে জানেন না। আজকের পোস্টের মাধ্যমে এরই বিস্তারিত তথ্য আমরা আপনাদেরকে জানানোর চেষ্টা করব।
ভূমিকা
পূজা হলো হিন্দু ধর্মের এক অপরিহার্য রীতি বা অনুষ্ঠান। প্রেম ও শ্রদ্ধার সাথে নানা রকম নৈবেদ্য উৎসর্গ করাকে পূজা বলা যায়। পূজার গুরুত্ব হিন্দু ধর্মে বিরাট আকারে বিস্তৃত তাই পূজা করার পূর্বে অবশ্যই পূজার অর্থ কি এবং পূজা কেন করা হয় তা জেনে রাখা জরুরী। আজকের এই আলোচনায় আমরা জানবো পূজা কি, পূজা কত প্রকার ও কি কি এবং পূজা কিভাবে করতে হয় এর বিস্তারিত সম্পর্কে।
পূজা অর্থ কি
সাধারণ অর্থে পূজার অর্থ শ্রদ্ধা করা। ভগবত সত্তার পরিচায়ক এবং ভগবৎগুণের প্রকাশক দেব গণদের শ্রদ্ধা জানাতে তথা গুন কীর্তন, সেবা ও প্রার্থনা করার আনুষ্ঠানিক আয়োজন হলো পূজা। সংস্কৃত শব্দ পূজা থেকে এর উদ্ভব হয়। পূজার অর্থ সম্মান, শ্রদ্ধা ও উপাসনা করা। জৈন বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পূজার প্রচলন রয়েছে।
এই ধর্মীয় বিশ্বাসীদের কর্তৃক আধ্যাত্মিকভাবে অনুষ্ঠান কিংবা পর্ব উদযাপন এর জন্য, দেবতাদের প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা ও প্রার্থনা করার জন্য কিংবা অতিথিকে তার আতিথ্য প্রদর্শন এবং সম্মান জানানোর জন্য পূজা করা হয়। সহজ কথায়, ঈশ্বর এবং সেবক এর মধ্যে ঐক্য এবং পবিত্র সম্পর্কই পূজা। উপলক্ষ, অঞ্চল, সম্প্রদায় এবং অনুসারীর দ্বারা অনুসরণীয় ভিন্ন ভিন্ন ধাপ অনুযায় পূজার ভিন্নতা হয়।
সনাতনের ইতি অনুযায়ী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পূজা করার বিধান রয়েছে। পূজা দৈনিক কিংবা বার্ষিক কিংবা আনুষ্ঠানিকভাবে হতে পারে। পূজা কেবল দেবতাগণদের জন্য নয় বরং জীবনে যেকোনো শুর বা নতুন উদ্যোগের জন্য পূজা অনুষ্ঠিত হয় তবে তা ধর্মীয় রীতি মেনেই অনুষ্ঠিত হয়।
পূজার গুরুত্ব
সামাজিক জীব মানুষ প্রাকৃতিকভাবে সমাজবদ্ধ ভাবে বসবাস করে।। এই সমাজবদ্ধ ভাবে প্রকৃতির মাঝে বসবাসের জন্য মানুষকে এবং সমাজকে সুগঠিত করে তোলে ধর্ম। ধর্মীয় দৃষ্টির সাথেই পূজা পার্বণ এর গুরুত্ব আধ্যাত্মিক ও আর্থসামাজিক দিক থেকেও প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। পূজা-পার্বণ সামাজিক মিলনের বাহক। কেবল পূজার কথা বলে এটি একটি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন এর প্রক্রিয়া এবং যখন সকলে মিলে একত্রিত হয়ে পূজা করে তখন এটি হয়ে ওঠে উৎসবমুখর পরিবেশ বা পার্বণ যাকে একত্রে পূজা-পার্বণ বলে।
পূজার উপকরণ সংগ্রহ করা, প্রতিমা আনয়ন এবং প্রতিমা স্থাপন, মন্দির সাজসজ্জা ও পূজার প্রস্তুতি করণ ও সাজসজ্জা, আরতি, ধূপের গন্ধ, পুজোর প্রসাদ ও আশীর্বাদ, নতুন কিংবা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিচ্ছদ পরিধানে মেতে ওঠা, প্রভৃতি আমাদের আত্মায় এবং পরিবেশে এক পবিত্র ও সুন্দর মনোভাবের জন্ম দেয়। ফলে পূজা করার মাধ্যমে আমাদের মধ্যে সৌহার্দ্য এবং ভ্রাতৃত্বের মনোভাব জাগ্রত হয়।
তাই পূজা শুধু ধর্মেই নয়, ধর্ম জ্ঞানে সঠিক মানুষ হতে এবং সামাজিকতার দিক থেকে উন্নত মানসিকতা নিয়ে আসতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মানুষের মনে একাগ্রতা এবং মানুষের সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয় পূজার মাধ্যমে। পূজা অর্চনার মাধ্যমে ভক্তের মনে ভক্তি ও একাগ্রতা জাগ্রত হয়। পূজার উদ্দেশ্য শুধু হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব কোনটি সেই পূজা করে সিদ্ধি লাভ অর্জন নয়।
পূজা এক সামাজিক মিলনেরও মাধ্যম হয়ে উঠে কেননা পূজা উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করা হয়। ধর্মীয় আলোচনা সভা, পূজা উপলক্ষে আয়োজিত মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানিকতার উদাহরণ। পূজা করা বিভিন্ন আয়োজন এবং পূজা অর্চনার মাধ্যমে এটি মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। প্রকৃতি ও ঋতুর সাথে নিজের জীবনে সাদৃশ্যবোধ গড়ে তুলতে পূজা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পূজা কত প্রকার ও কি কি
ভগবানকে শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্য গুণ কীর্তন, প্রার্থনা, প্রণাম ইত্যাদির আনুষ্ঠানিক আয়োজনকে পূজা বলে। পূজা সাধারণত দুই প্রকারের। একটি কাম্য কর্মাত্নক পূজা এবং অপরটি নিষ্কাম পূজা।
কাম্য-কর্মাত্নক পূজাঃ ক্ষুদ্র কামনা যুক্ত আমার স্বার্থের রচিত পূজাকে কাম্য কর্মাত্নক পূজা বলে। নিজের জন্য সিদ্ধির লক্ষ্যে বা স্বীয় উদ্দেশ্যে ধন, বিদ্যা, বুদ্ধি, জন, রোগ থেকে মুক্তি ইত্যাদি নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য যে পূজা অর্চনা করা হয় তা কাম্য কর্মাত্নক পূজা।
নিষ্কাম পূজাঃ মহৎ কামনাযুক্ত পূজাকে নিষ্কাম পূজা হিসেবে অভিহিত করা হয়। বহু উন্নয়ন, বহুর কল্যান এবং বহু সমৃদ্ধি উদ্দেশ্য নিয়ে লক্ষ-প্রেসন করে যখন পূজা যজ্ঞ বা মানবিক ও সামাজিক সেবামূলক কর্মের মাধ্যমে পূজা অর্চনা করা হয় তখন তাকে নিষ্কাম পূজা বলা হয়। অর্থাৎ কেবলমাত্র যজ্ঞ করার মাধ্যমেই নয় যে কোন সেবামূলক ও মহৎ কামনাযুক্ত কর্মাদির বিষয়কে পূজা হিসেবে গণ্য করা হয়।
উপাচার ভেদে পূজা চার প্রকার। অর্থাৎ উপকরণ ভেদে পূজাকে চারভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যথাঃ
- পঞ্চ উপচারে পূজা
- বহু উপচারে পূজা
- স্বল্প উপচারে পূজা এবং
- উপচারবিহীন পূজা।
পঞ্চ উপচারে পূজাঃ সুগন্ধ দ্রব্য- চন্দনাদি, নৈবেদ্য, জল, ধূপ-দীপ এবং ফুল এই পাঁচ উপকরণ দ্বারা পূজা পদ্ধতিকে পঞ্চ উপচারের পূজা বলে অভিহিত করা হয়। পঞ্চ উপচার কে বলা হয় যথাক্রমে ক্ষিমি, অপ, তেজ, মরুত এবং ব্যোম বা শরীর, মন, প্রাণ, বেদন এবং অহম কিংবা বস্তুময়, প্রাণময়, মনোময়, বোধময় ও আনন্দময়। এগুলোকে জীবন ক্ষেত্রের প্রতীক বলা হয়।
বহু উপচারে পূজাঃ কৃষ্ণ দেবতার প্রীতি লাভের জন্য ভক্ত কিংবা পূজারী বহু উপচারে পূজা করতে পারেন যা হতে পারে দশ, শত বা সহস্র উপচার নিয়ে। দশ উপাচারে বা ষোড়শ উপাচারে সাধারণত বারোয়ারি বা সার্বজনীন পূজা করা হয়ে থাকে। এরূপ পঞ্চউপচার সহ এর অধিক উপকরণ সহ পূজাকে বহু উপাচারে পূজা বলা যায়। নিম্নে বহু উপচারের কিছু সামগ্রীর নাম উল্লেখ করা হলো।
দশ উপচারের সামগ্রীঃ পাদ্য, মধুপর্ক, পুনরাচমনীয়, অর্ঘ্য অচমনীয়, জল, গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দ্বীপ ও নৈবদ্য।
ষোড়শোপচারঃ স্বাগত, আসন, পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, মধুপর্ক, নৈবদ্য, বন্দনা, পুনরাচমনীয়, স্নানীয়, বাসন, গন্ধ, ধূপ, দীপ, আভারণ, সমাপ্তি অনুষ্ঠান হিসেবে হোম এবং বলি।
স্বল্প উপচারে পূজাঃ পঞ্চ প্রচারের বদলে কারণ ভিত্তিক ভাবে অল্প শামুকে দিয়ে পূজা করার বিধিকে স্বল্প উপচারে পূজা বলে। যখন কোন অজানা কিংবা অচেনা স্থানে পূজা অর্চনার প্রয়োজন বোধহয় এবং শত চেষ্টার সত্ত্বেও যখন পঞ্চউপচার সংগ্রহ সম্ভব হয়ে ওঠে না তখন যে পূজা পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় তাকে স্বল্প উপচারে করা পূজা বলা হয়।
উপচারবিহীন পূজাঃ উপচার বিহীন পূজাকে কিছু ক্ষেত্রে মানস পূজা বলা হয়ে থাকে। পূজারী নিজের অন্তরে পঞ্চ উপচারের স্বরূপ হিসেবে বস্তু ময়, প্রাণময়, মনোময়, বোধময় এবং আনন্দময় কিংবা ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরৎ, ব্যোম পঞ্চ ও প্রচারের নাম এ ভগবানের নিকট নিবেদন করাকে উপচারবিহীন পূজা কিংবা মানস পূজা বলে। সূক্ষ্ম থেকে অতি সূক্ষ্ম উপকরণ অর্পণ করে ওপাশের নিকট নিবেদন করে মানস পূজা করা হয়।
আবার, জমজান কিংবা পূজারীর মানসিকতা ভেদে পূজাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যা যথাক্রমে ব্যক্তিগত পূজা এবং সমষ্টিগত পূজা হিসেবে পরিচিত।
ব্যক্তিগত পূজাঃ ব্যক্তিগত পূজা কোন না কোনভাবে মানস পূজা পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত। ব্যক্তিগত পূজার মধ্যে ব্যক্তি নিজেই পূজারী হয়ে পূজা করে এ পূজার উপচার প্রধান বিষয় নয় বরং ব্যক্তিগত সাধনা করা মূল লক্ষ্য।
সমষ্টিগত পূজাঃ একাধিক লোক যখন পুরোহিত এর মাধ্যমে নিজের পূজা ভগবানকে অর্পণ করে থাকেন তখন তাকে সমস্তগত পূজা বলে। এই পূজায় অনেকগুলো লোক একজন পুরোহিতের উপর নির্ভরশীল থাকেন এবং তার করা পূজা পদ্ধতিতে বাকিরা তাকে অনুসরণ করে থাকেন। সমষ্টিগত পূজা সাধারণত বহু উপচার নিবেদনের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে তবে বিরল ক্ষেত্রে এটি পঞ্চ উপচার অর্পনেও করা হয়ে থাকে। সমষ্টিগত পূজা অবশ্যই বেশ আনুষ্ঠানিকতার সাথে করা হয় যেখানে একসাথে অনেক লোক একত্রিত হয়ে একটি পার্বণের মতো পরিবেশের জন্ম নেয়।
পূজা কেন করা হয়
পূজার মুখ্য উদ্দেশ্য হলো উপাস্যকে ভক্তি ও শ্রদ্ধা নিবেদন করা। ধর্মীয় ব্যাখ্যায় বলা যায় ভক্ত নিজের জীবনকে আনন্দময় ও কল্যাণময় করে তোলার জন্য শ্রীচৈতন্যময়ী প্রকৃতির পূজা করে তাকে তুষ্ট করে থাকেন। প্রাচীন বাংলায় আজ থেকে প্রায় ৩ হাজার বছর পূর্বে পূজার প্রাথমিক একটি ধারণা জন্ম নেয়। অনার্য নিষাদ দের জন্য তন্ত্র, সাংখ্য এবং যোগ এই তিনটি ছিলো ধর্মের প্রতি তাদের তাদের আদিম ও স্বতঃস্ফূর্ত বিশ্বাস। তবে আর্য নিষাদ দের এই ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি আর্যরাও বিশ্বাস রাখতেন তাই এই তিনটি সাংখ্য তন্ত্র এবং যোগ দ্বারা তারাও প্রভাবিত ছিল। এই বিষয়ে ড. আহমদ শরীফ এর মতানুযায়ী,
দেশি শব্দের সাথে বৈদিক ভাষায় যোগ পদ্ধতিও গভীরভাবে গৃহীত হয়েছে। বেশি জন্মান্তরবাদ, প্রতিমার পূজার্চনা, প্রকৃতিতে পশু বৃক্ষ নারী ও প্রাকৃতিক জীবের স্বীকৃতি, দেবতাগণ দের স্বীকৃতি, কর্মবাদ, মায়াবাদ, প্রেত ও আত্মা তত্ত্ব, মন্দির উপাসনা প্রভৃতির বিকাশ ঘটে পূজার মাধ্যমে। তাছাড়া তান্ত্রিকদের ভূতশুদ্ধি ও যোগীর দেহ ও মন শুদ্ধির জন্য উপাস্যের প্রতি পূজা নিয়োজিত করা হয় যা প্রাচীন ঐতিহ্যের মতানুযায়ী আর্য শাস্ত্রের মর্যাদায় নিয়োজিত।
তবে ধর্মের সহজ উপাসকদের জন্য পূজার অর্চনার অন্য এবং মূল কারণ হল ভক্তি প্রদর্শন করা যা সহজেই বোধগম্য। অভক্তির সাথে পূজা করলে কিংবা পূজারী যখন পূজা করে তার হৃদয়ে যদি ভক্তির জন্ম না নেয় তখন সেই পূজা অর্থহীন হয়ে যায়। পূজা হলো এক পদ্ধতি যা নিষাদগণ বিভিন্ন উপাচার বা উপকরণ এর মাধ্যমে করতে যা তারা তাদের নিজস্ব পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করতেন।
পূজা করার মাধ্যমে চৈতন্যময়ী প্রকৃতিকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্য রাখা হয় যেন পূজারির জীবন হয়ে ওঠে কল্যাণময় এবং আনন্দময়। প্রজাতত্ত্বের মাধ্যমে করা হয় যার অর্থ দর্শন বা তত্ত্বে এসে দাঁড়ায়। তত্ত্বের মূল হল প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ীর রুপ মনে করা। শাস্ত্র অনুযায়ী তন্ত্র সাধনের ফলে জীবের ত্রান বা মুক্তি অর্থাৎ মোক্ষ্য লাভ হয়।
এটি পূজার আরেকটি উদ্দেশ্য। হিন্দু ধর্মে হিন্দুদের তন্ত্র প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত হয় একে ত্রিবিধ বলা হয় যেগুলো হলোঃ শৈব, শাক্ত এবং বৈষ্ণব। পূজার দুটি বিষয় হলোঃ একটি মন্ত্র ও দ্বিতীয়টি উপচার। আর হিন্দু ধর্মে বারো মাসে তেরো পূজা মানে জানতে হলে পূজার কারণ এবং উৎপত্তি অবশ্যই জানা দরকার একই সাথে হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব কোনটি এর ও উত্তর বের হয়ে আসবে।
পূজা কিভাবে করতে হয়
যিনি সত্যের প্রতিনিধিত্ব করেন তিনিই সত্যনারায়ণ। কলি যুগে যারা সত্যনারায়ণের পূজা করবেন, নারায়ণ তাদের কলিযুগের মতো কঠিন যুগে তাদের সাহায্য করবেন। পূজা পাঠ এর সহজ নিয়মাবলীঃ
পূজা করার জন্য প্রথম ধাপ হল অবশ্যই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকা। নিত্যদিনের পূজায় অবশ্যই প্রথমে স্নান সেরে ইস্ট দেবের মন্ত্র জপের মাধ্যমে মন্দিরে প্রবেশ করতে হবে এবং আচমন করার সাথে ইষ্ট মন্ত্র জপ করে কৃষ্ণ দেবতাকে ধূপ ও প্রদীপ দিতে হবে।
আচমনের নিয়মঃ নমঃ শ্রী বিষ্ণু তিনবারে উচ্চারণ করে মাসকলাই ডুবানো যাবে সর্বনিম্ন এই পরিমাণ জল হাতে নিয়ে তিনবার ভগবানকে প্রণাম করতে হবে। এরপর আচমন জন্য দুহাত জোড় করে বলতে হবে-
"ওঁ অপবিত্র পবিত্রবা সর্বাবস্থায় গতোহপিবা,
য স্মরেৎ পুণ্ডরীকক্ষন স বাহ্য অভ্যন্তর সূচি।।"
ভূমিশুদ্ধিঃ আচমনের পর করতে হবে ভূমিশুদ্ধি। তার জন্য হাতে অল্প পরিমাণ জল নিয়ে পাঠ করতে হবে "ওঁ রক্ষ রক্ষ হুং ফট স্বাহা" এবং মন্ত্র পাঠ করা সেই জল মাটিতে ছিটিয়ে দিতে হবে।
আসনের শুদ্ধিকরণঃ পরবর্তী ধাপ হিসেবে থাকবে আসনের শুদ্ধিকরণ। পূজার আসনের উপরে ত্রিকন মন্ডল এঁকে চন্দন ও পুষ্প গ্রহণ করতে হবে এবং পাঠ করতে হবে- "এতে গন্ধ পুষ্পে ওঁ হ্রী আঁধারশক্তয়ে কমলাসনায় নমঃ।"। এই মন্ত্র পাঠ করার সময় আসনের উপর পুষ্পসামগ্রী আসনে স্পর্শ করে পাঠ করতে হবে।
জল ও পুষ্প শুদ্ধির মন্ত্রঃ এরপরে জল ও পুষ্প শুদ্ধির মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে জল শুদ্ধি এবং পুষ্পশুদ্ধি করে সেই জল নিয়ে উপচার অর্থাৎ পূজার দ্রব্যের উপর এবং দেবতায় " ওঁ বীজ মন্ত্র ফট" বলে ছিটয়ে দিতে হবে।
আত্মশুদ্ধির মন্ত্রঃ এরপর নিজের আত্মশুদ্ধির জন্য কৃষ্ণ দেবতার মূল মন্ত্র পাঠ করে আত্মশুদ্ধি করতে হবে। যেমন শ্রীকৃষ্ণ পূজা পদ্ধতিতে আত্মশুদ্ধির জন্য মন্ত্রের শুরুতে এবং শেষে ওঁ যোগ করে পাঠ করতে হবে-
"ওঁ ক্লীং কৃষ্ণায় গোপীজনবল্লভায় স্বাহা ওঁ।"
নিত্য পূজার নিয়মঃ এরপর নিত্য পূজার নিয়ম অনুসারে পূজা করে যেতে হবে। প্রথমেই ইষ্ট দেবতার পা ধোবার জল অর্পণ করে বলতে হবে "এতৎ পাদ্যম ওঁ দেবায় নমঃ।" এবং তারপর প্রাণের জল, গন্ধ, পুষ্প অর্পনের মন্ত্র পাঠ করে পঞ্চ উপচার বা সাধ্য অনুযায়ী উপচার দিয়ে কিংবা বিনা উপাচারে ভগবানের উদ্দেশ্যে পূজা করতে হবে।
নৈবেদ্যের জন্যঃ
"এতৎ সোপকরণ নৈবেদ্যম।"
"ইদং পানার্থ দকোং।"
"ইদং পুনরাচমনীয় দকোং।"
প্রনাম মন্ত্রঃ সবশেষে প্রনাম মন্ত্রের সাথে অঞ্জলি দিয়ে ইষ্ট দেবতার জব করতে হবে এবং জব সমর্পণের জন্য মুঠোয় নেয়া জল এর সাথে পাঠ করতে হবে-
"ওঁ গুহ্যাতিগুহ্য গোপ্তাত্বং/গোপ্তীত্বং গৃহাণস্মাৎ কৃতং জপম,
সিদ্ধির্ভবতু মে দেব/দেবী তৎ প্রসাদাৎ সুরেশ্বর/জনার্দন/তৎপ্রসাদান্মহেশ্বরী/মহেশ্বর।"
পূজার সকল নিয়ম শেষে অবশ্যই কাসার ঘন্টা কিংবা শঙ্খ ধ্বনি বাজাতে হবে তবে এই নিয়মে স্থানভিত্তিক বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন হওয়ার শঙ্কা থাকতে পারে।
হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব কোনটি
সনাতন ধর্মে পূজা ও পার্বণের শেষ নেই। এত এত দেব-দেবীর পূজা পাঠ ও দেব দেবীর পূজা আনুষ্ঠানিকতার সাথে অর্চনা করার মাধ্যমে এই উৎসবমুখর পরিবেশ প্রায় সারা বছরই বিদ্যমান থাকে। তাইতো বলা হয় হিন্দু ধর্মে বারো মাসে তেরো পূজা মানে, মাস না গরাতেই নতুন পুজোর দেখা মেলে। তবে প্রসঙ্গ যখন হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব কোনটি, তখন এর উত্তরে বলা যায় দুর্গা পূজাকে হিন্দুদের প্রধান ও বছরের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব হিসেবে গণ্য করা হয়।
অর্থাৎ মা সারদার আগমনে আমাদের ধর্মে সবচেয়ে বড় উৎসবের আয়োজন হয়। তবে বিশ্লেষিত আলোচনায় এমন কথা উঠে আসে যে, সকল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিকট প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা নয় বরং এটি কেবলমাত্র পশ্চিমবাংলা এবং বাংলাদেশের হিন্দু-ভাষীদের জন্য সর্ববৃহৎ এবং প্রধান ধর্মীয় উৎসব।
কারণ রামায়ণের সংস্কৃত রচনায় দুর্গাপূজার উল্লেখ করা হয়নি। তবে বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে ওড়িশা, বিহার, বঙ্গ অঞ্চল, উত্তর ঝাড়খন্ড ও ঝাড়খন্ড এলাকায়, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক এবং উত্তর প্রদেশের আরোও অঞ্চলে দুর্গা পূজার পর্যায়ক্রমিক দিনগুলোকে ভাগ করে প্রধান ধর্মীয় উৎসবের মত আয়োজনে মেতে প্রায় সমস্ত সনাতনী সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্গাপূজা পালিত হয় তাই একে হিন্দু ধর্মের প্রধান ধর্মীয় উৎসব বলা হয়।
বারো মাসে তেরো পূজা মানে
কথায় আছে, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। অর্থাৎ সারা বছরই কোন না কোন ধর্মীয় উৎসব কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠান চলতেই থাকে। পার্বণের প্রচলিত অর্থ হলো এমন এক উৎসব যা বিশেষ দিনে ক্রিয়া বা পূজার রীতিতে পালিত হয়। আর আমাদের বাংলা মাসের প্রায় প্রতিটি মাসেই একা একাধিক পূজা অনুষ্ঠিত হবার কারণ হলো প্রকৃতির প্রতিটি অংশকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ধর্মের সঙ্গে লিপ্ত করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
বাংলায় বাংলার কিছু মাসকে স্বাগত জানিয়ে কিংবা কিছু মাসকে বিদায় দিয়ে অথবা কিছু মাসে নির্ধারিত পুজোবিধির মাধ্যমে তার প্রতি মাসে কোন না কোন বা এক বা একাধিক পুজো থেকে থাকে। এই আমেজ পুরো বছর চলতে থাকে। দিন গুনে যদি মাসের সাথে এক একটি পূজার তালিকা দেয়া হয় তাও বারো মাসের সাথে মিলিয়ে পূজার তালিকা মাসে সংখ্যা পর্যন্ত আবদ্ধ থাকবে না। এ কারণেই বলা হয় হিন্দু ধর্মের বারো মাসে তেরো পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
লেখকের মন্তব্য
উপরোক্ত আলোচনা প্রেক্ষিতে হিন্দু ধর্মে পূজার গুরুত্ব এবং পূজার তাৎপর্য উপলব্ধ করা যায়। আশা করছি উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আপনারা হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব কোনটি এবং বিস্তারিত বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। এই আলোচনার ভিত্তিতে আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে বা আপনার কোন মতামত আমাদেরকে জানাতে চান তাহলে অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করুন এবং আমাদের পোস্টটি শেয়ার করার মাধ্যমে আশেপাশের সকলকে হিন্দু ধর্মে পূজা পার্বন সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ করে দিন।
ধন্যবাদ
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url